যেকোনো শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকে। আমার দুই মেয়ে, ফাতিমা ও মারইয়ামকে কী কী ও কীভাবে শিখিয়েছি তার কিছু বিবরণ দেয়া হলো।
ভালো কাজ ডান দিক থেকে শুরু করা:
ওরা খুব ছোট থেকেই ঠিকভাবে জুতা পরতে পারে। মানে, ডান পায়ের জুতা ডান পায়ে, আর বাম পায়ের জুতা বাম পায়ে পরে। তবে কোন্ পায়ে জুতা আগে পরতে হবে সেটা বুঝতো না। তখন ওদের শেখানো হলো ডান পায়ের জুতা আগে পরতে হয়।
ওদের যখন কাপড় পরাতাম, তখন ডান হাতে/পায়ে আগে পরাতাম। এখন একা একাই কাপড় পরতে পারে।
এখন ফাতিমার প্রায় সাড়ে চার বছর বয়স। একা একা ভাত খাওয়ার অভ্যাসটা এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ওদের মা-ই তিনবেলা ভাত খাইয়ে দেয়। তবে রুটি, মুড়ি, চানাচুর, বিস্কুট, ফলফলাদি ইত্যাদি খাবার একা একাই খায়। অনেক সময় বাম হাতে খাওয়া শুরু করে দেয়। মাঝে মাঝে দুহাত মাখিয়ে একাকার। তখন ওদের ডান হাতে খেতে বলি। আমার কথা শুনে ডান হাতে খেতে থাকে, আলহামদুলিল্লাহ।
ইসলাম চর্চা:
মসজিদ বা অফিসের উদ্দেশ্যে অথবা অন্য কোনো কাজে ঘর থেকে বের হলে সালাম দিয়ে বের হই। একইভাবে ঘরে ঢুকার সময়েও সালাম দিই। সালাম দেয়ার পর মাঝেমাঝে “ওয়া আলাইকুমুস সালাম” বলতে বলি, যেনো ওরা সালাম দেয়া শিখতে পারে।
ওদেরকে নিয়ে যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামি তখন অল্প আওয়াজে “সুবহানাল্লাহ্” বলি, ওদেরকেও বলতে বলি। আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসার সময় “আল্লাহু আকবার” বলতে বলতে উঠি। আমার দেখাদেখি ওরাও বলে, মাশা-আল্লাহ্। তারপর ওদের বুঝিতে দিই, উপরে উঠতে “আল্লাহু আকবার”, আর নিচে নামতে “সুবহানাল্লাহ্” বলতে হয়।
হয়তো ফাতিমাকে পড়াচ্ছি। এমন সময় মুয়াজ্জিন এশার আযান শুরু করে দিলো। তখন পড়া থামিয়ে ফাতিমাকে আযানের জবাব দিতে বলি। ও বলে, কীভাবে আযানের জবাব দিতে হয়। বলি, মুয়াজ্জিন যা বলে তাই বলো। তারপর ওদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে আযানের জবাব দিতে থাকি।
পশুপাখির পরিচয়:
ফাতিমার এক বছর বয়সেই ওর জেঠার সাথে ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ওর জেঠা ওকে পশুপাখির ছবি সম্বলিত বই এনে দিয়েছিল। সে জেঠাই ঐ বইয়ের সাহায্যে বিভিন্ন প্রাণীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
ছবির কারণে অবশ্য কিছু সমস্যাও ছিলো। যখন বলের ছবি দেখিয়ে বলতাম, এটা বল। তখন বলত, বল দাও। তারপর আরেকটু স্পষ্ট করে বলতাম, এটা বলের ছবি। তারপরও বলের জন্য কান্না জুড়ে দিতো।
স্বজনদের নাম শেখানো:
ফাতিমার বয়স যখন সম্ভবত তিন বছর, তখন ওর নিজের নাম, বোনের নাম, বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানীর নাম শেখাই। তারপর কিছুদিন পর জিজ্ঞেস করলে কিছু পারতো, কিছু ভুলে যেতো। তখন নামগুলো আবার শিখিয়ে দিতাম। মারইয়ামকে এখনো সেভাবে শিখানো হয়নি। তারপরও ও নিজের, বড় বোনের ও বাবা-মার নাম বলতে পারে।
বই খাওয়া:
একজনের জন্য আনলে অন্যজন কান্না জুড়ে দিতো। আর মারইয়াম তো ফাতিমারটা নিয়েই নিতো। মাঝে মাঝে ঝগড়া বাধিয়ে দিতো।
যাই হোক, দুজনের জন্যে দুটো বই আনতাম। দু’একদিন যেতে না যেতেই বই ছিঁড়ে লণ্ডভণ্ড করে ফেলতো। বিশেষ করে, বইয়ের প্লাস্টিকের পাতলা কভারটার দফারফা করে ছাড়তো। কিছু অংশ মুখে দিয়ে চিবাতো।
ফাতিমা এখন বড়ো হয়েছে, বুঝতে শিখেছে। এখন আর বই ছিঁড়ে না। তবে মারইয়াম এখনো বই ছিঁড়ে। পেন্সিল ভাঙে। দুই-তিনদিন আগেও একটা পেন্সিলের আগাগোড়া ভেঙে বেখাপ্পা বানিয়ে ছেড়েছে।
ধারণাতীত স্মরণশক্তি:
ফাতিমার মনে রাখার শক্তি খুবই প্রখর। ভালো করে মনোযোগ দিলে খুব সহজেই একটা সূরা মুখস্থ করে নেয়। ওকে যখন স্বরবর্ণ অ-আ ইত্যাদি শেখাতে শুরু করি, তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে খুব দ্রুতই শিখে নেয়। তবে সমস্যা হলো পড়ায় মনোযোগ খুব কমই দেয়। খেলাচ্ছলে শেখাতে হয়।
খেলাচ্ছলে শেখানো:
ফাতিমা এখন বাংলা বানান শিখছে। তবে পড়ায় সহজে মনোযোগ দেয় না। তখন হঠাৎ বলি, এই যে হাতি। বলে, হাতি কোথায়? তখন বইয়ে হাতি শব্দের বানান পড়িয়ে দেই – “হ আ-কার হা, ত ই-কার তি, হাতি”।
মারইয়াম একদম পড়তে চায় না। ওকে বলি, ভালো করে পড়ো। তাহলে তোমার আপার মতো তুমিও হাতি দেখতে পাবে। দেখোনা তোমার আপা হাতি দেখছে! তখন ফাতিমাও আমার সাথে তাল মেলায়।
মাঝে মাঝে পড়িয়ে দিতে গেলে বলে, একা একাই। মানে, ও নিজে নিজে বানানটা বা পড়াটা বলতে চাচ্ছে। তখন ওকে সুযোগ দেই। ভুল হলে শুধরিয়ে দেই।
আবার যখন কোনো কিছু পারে তখন “মাশাআল্লাহ্” বলে উৎসাহ দেই।
প্রশ্ন আর প্রশ্ন:
শুধু আমরা যে শিখাই, তা না। অনেক কিছু ওরা নিজে নিজেও শিখে। সেদিন দেখি মারইয়াম কাগজে থুথু লাগিয়ে স্টিকারের মতো বানিয়ে গায়ে লাগাচ্ছে। ওর খেলায় মনোযোগ বেশি।
আর ফাতিমার জানার আগ্রহ বেশি। শুধু প্রশ্ন — কী, কেনো, কীভাবে, কোথায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি অল্পতেই রেগে যাই। তাই আমাকে বেশি ঘাটায় না। তবে ওর মাকে প্রশ্ন করতে করতে অতিষ্ঠ করে তোলে।