আমরা যারা সিলিন্ডার গ্যাস অর্থাৎ Liquefied Petroleum Gas (LPG) ব্যবহার করি তারা গ্যাসের খরচ কমানোর বিভিন্ন উপায় খুঁজি। আমাদের জন্যে স্বল্প গ্যাসে ও স্বল্প খরচে রান্না করাটা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। অথচ একটু সাবধান হলেই বাড়তি গ্যাসের অপচয়টা কমিয়ে ফেলতে পারি। সেই সাথে কমিয়ে ফেলতে পারি সিলিন্ডার গ্যাসে রান্নার খরচ। তাহলে চলুন জেনে নিই রান্নাঘরে গ্যাসের ব্যবহার ও খরচ কমানোর কিছু উপায়।
১। গ্যাস খরচ কমাতে রান্নার পূর্বে করণীয়:
গ্যাস খরচ কমানোর উপায়গুলোকে আমরা রান্নাপূর্ব, রান্নাকালীন ও রান্নাপরবর্তী এভাবে ভাগ করতে পারি। রান্না শুরু করার আগে আমাদের যেসব বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।
১.১ ডিফ্রস্ট (Defrost) করে চুলায় দেয়া
ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা উপকরণগুলো বের করার পরপরই রান্না শুরু করলে তা গরম হতে হতেই অনেকটুকু গ্যস খরচ হয়ে যায়। তাই রান্নার আগে উপকরণগুলো ফ্রিজ থেকে বের করে ডিফ্রস্ট করে রাখতে হবে। তেমনি ফ্রিজের খাবার সরাসরি গরম করে খেতে গেলে বেশি গ্যাস খরচ হবে। তাই খাবারগুলো যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এনে তারপর গরম করতে হবে।
১.২ রান্নার আগে ভিজিয়ে রাখা
ছোলা, ডাল ইত্যাদি সিদ্ধ হতে অনেক সময় লাগে। সেজন্য এগুলো ভিজিয়ে রেখে তারপর রান্না করলে তাড়াতাড়ি সিদ্ধ হবে। কমবে গ্যাসের ব্যবহার।
১.৩ রান্নার উপকরণ প্রস্তুত করে রান্না শুরু করা
আমরা প্রায়ই সময় বাঁচানোর জন্য একদিকে চুলা জ্বালিয়ে রাখি, অন্যদিকে রান্নার উপকরণ প্রস্তুত করতে থাকি। এরকম না করে জিনিসপত্র রান্নার জন্য প্রস্তুত করার পর রান্না শুরু করতে হবে। যেমন- শাকসবজি কেটে রেখে তারপর রান্না শুরু করতে হবে।
১.৪ হাতের নাগালের কাছে সবকিছু রাখা
রান্না শুরুর আগেই হাতের নাগালে সব দরকারি জিনিসপত্র রেখে দিতে হবে। অনেকসময় চুলা জ্বালিয়ে তারপর সবজি কাটা, থালা-বাটি খোঁজা, রান্নার পাত্র খোঁজা শুরু করেন অনেকে। এতে করে খরচ হয় অনেকখানি বাড়তি গ্যাস।
১.৫ উপযুক্ত আকারের পাত্র ব্যবহার করা
রান্নার পাত্র যেন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বড় না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তা না হলে তরকারি সিদ্ধ হতে অনেক সময় লাগবে।
১.৬ প্রেসার কুকার ব্যবহার করা
রান্না করার পাত্র হিসেবে বেছে নেয়া যায় প্রেসার কুকারকে। এতে সময় বাঁচার পাশাপাশি গ্যাসও বেঁচে যাবে অনেকটা।
১.৭ শুকনো পাত্র ব্যবহার করা
রান্না শুরু করার সময় খেয়াল রাখতে হবে রান্নার পাত্র শুকনো আছে নাকি ভেজা। কারণ পাত্রটি ভেজা থাকলে সেটা শুকাতে গিয়ে খরচ হয়ে যায় অনেকখানি গ্যাস।
১.৮ ছোটো ছোটো টুকরা করে রান্না করা
মাংস, আলু বা অনান্য সবজি যথাসম্ভব ছোটো ছোটো টুকরা করে রান্না করলে দ্রুত সিদ্ধ হয়। ফলে গ্যাস কম খরচ হয় ।
২। গ্যাসের অপচয় রোধে রান্নাকালীন করণীয়:
গ্যাসের অপচয় কমাতে রান্নার আগের বিষয়গুলো লক্ষ্য করার পাশাপাশি রান্নার সময়েও কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। এগুলো নিচে দেয়া হলো।
২.১ ঢেকে রান্না করা
রান্না করার সময় ঢাকনা লাগিয়ে রান্না করতে হবে। এতে করে বাষ্প ভেতরে জমবে। রান্না হবে তাড়াতাড়ি। গ্যাস বাঁচবে।
২.২ মাটির খুরা কিংবা কাচের ঢাকনা ব্যবহার করা
এগুলোর মধ্য দিয়ে তাপ কম বেরোতে পারে। ফলে রান্নার পাত্র কম গ্যাসেই গরম হতে পারে। আবার ভাতের ফেন উঠলে অ্যালুমিনিয়ামের পাতলা ঢাকনা পরে যায়। সেক্ষেত্রে মাটির খুরা ব্যবহার করা যায়।
২.৩ প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার না করা
প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা যাবে না, তা না হলে ঐ পানি কমানোর জন্য অতিরিক্ত গ্যাস খরচ হবে। তরকারিতে ঠিক ততটুকু পানি দিতে হবে যতটা দরকার। কারণ বেশি পানি দিলে তাতে করে সেটা শুকাতে এবং রান্না হতে সময় নেয়। ফলে গ্যাস খরচ হয়।
২.৪ চুলার আঁচ কমিয়ে দেয়া
রান্নার পুরোটা সময় জ্বালের মাত্রা এক থাকার দরকার নেই। তাই বাসন গরম হয়ে যাওয়ার পর এবং পানি ফোটা শুরু হলে আঁচ কমিয়ে দেয়া যায়। কম আঁচে রান্না করলে গ্যাস কম খরচ হবে।
২.৫ ভাঁপে রান্না করা
পরিপূর্ণ রান্না হবার অল্প সময় পূর্বেই চুলা বন্ধ করে দেয়া যায়। ঢেকে রাখলে ভাঁপে বাকি রান্না হয়ে যাবে।
২.৬ বেশি জ্বাল-দেয়া (Overcooking) পরিহার করা
খাবার তৈরি হয়ে যাবার পরও অনেকে জ্বাল দিতে থাকেন। এতে স্বাভাবিকভাবেই গ্যাসের অপচয় হয় এবং গ্যাস খরচও বেড়ে যায়। যেমন, ভাত ফুটে যাওয়ার পরও অনেকে পানি সম্পূর্ণ দূর করতে জ্বাল দিতে থাকেন। অথচ অল্প একটু পানি থাকতে জ্বাল বন্ধ করে ঢাকনা খুলে রাখলে তা সহজেই শুকিয়ে যায়।
২.৭ সময় জেনে এবং সময় ধরে রান্না করা
যেমন- পানি ফোটার পর দশ মিনিট রাখলেই ডিম সিদ্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় সিদ্ধ করা গ্যাস অপচয়েরই নামান্তর।
২.৮ ঝড়ো হাওয়া এড়িয়ে চলা
রান্নার সময় বাতাসের ঝাপটা লাগলে চুলার আগুনের তেজ কমে যায়। এতে গ্যাস অপচয় হওয়ার পাশাপাশি রান্না শেষ হতেও দেরি হয়। তাই বাতাসের বেগ থাকলে, চুলাটা বাতাস থেকে আড়াল করে রান্না করা উচিত।
৩। রান্না-পরবর্তী ও অন্যান্য করণীয় কাজ:
৩.১ সরু নজলের (Nozzle) চুলা ব্যবহার করা
গ্যাসের চুলার সুইচ বা নবের সাথে নজল লাগানো থাকে। নজলের ছিদ্র বড় হলে বেশি গ্যাস বের হয়। ফলে আগুনও বেশি হয়। বেশি আগুনের প্রয়োজন না হলে সরু ছিদ্রের নজল লাগিয়ে নেয়া ভালো।
৩.২ চুলা পরিষ্কার রাখা
চুলার বার্নার অপরিষ্কার থাকলে, নজলে ময়লা জমলে কিংবা বাতাসের রেগুলেটর ঠিকমতো সমন্বয় (Adjust) করা না হলে আগুন লাল হয়ে জ্বলে। লাল আগুন মানে গ্যাস পুরোপুরি দাহ্য হয়নি। আর গ্যাস পুরোপুরি দাহ্য না হলে তাপও কম উৎপন্ন হবে। ফলে রান্না করতে বেশি গ্যাসের প্রয়োজন পড়বে। অপরদিকে নীল আলোতে সর্বাধিক তাপ উৎপন্ন হয়, গ্যাস অপচয় কম হয়।
৩.৩ ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা
পানি গরম করার জন্য ইলেকট্রিক কেতলি ব্যবহার করা যায়। এতে গ্যাসের ওপর চাপ কম পড়বে। ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং অবশ্যই বিদ্যুৎ বিলের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
৩.৪ থার্মোফ্লাস্ক ব্যবহার করা
যদি বেশি চা, কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকে তাহলে বার বার গ্যাস ওভেনে পানি গরম না করে থার্মোফ্লাস্ক ব্যবহার করা যায়। একইভাবে শীতকালে গরম পানির জন্য থার্মোফ্লাক্স ব্যবহার করা যায়।
৩.৫ একসাথে গরম করা
ফ্রিজের খাবার গরম করার ক্ষেত্রে, পাত্রগুলো একটার উপর আরেকটা রেখে একসাথে গরম করা যায়। এতে করে অল্প গ্যাসে সব খাবার গরম করা যাবে। আবার এইমাত্র রান্নাকরা গরম পাতিলের উপর ঠান্ডা খাবারের পাত্র রেখে দিলে ঐ তাপেই ঠান্ডা খাবার গরম হয়ে যাবে। ভাতের ক্ষেত্রে, গরম ভাতের উপর ঠান্ডা ভাত ছড়িয়ে পাতিল ঢেকে দিতে হবে।
৩.৬ চুলা, গ্যাস লাইন চেক করা
নিয়মিত গ্যাসের চুলা, রেগুলেটর, পাইপ ইত্যাদি চেক করতে হবে। সামান্য লিক থেকে অনেক গ্যাস নষ্ট হতে পারে, এমনকি অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। আবার বার্নারে সমস্যা থাকলে মাঝখানে আগুন না জ্বলে একদিকে বেশি আগুন সৃষ্টি হতে পারে। যা গ্যাস অপচয়ের পাশাপাশি চুলারও ক্ষতি করে থাকে। রান্না হয়ে গেলে অবশ্যই সিলিন্ডারের রেগুলেটর বন্ধ করে রাখতে হবে।
উপরের বিষয়গুলো মেনে চললে গ্যাসের অপচয় কমার পাশাপাশি খরচও অনেকটা কমে যাবে। বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করলে, এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতেও অনেক সাশ্রয় হবে। এছাড়া পরিবেশও বিপর্যয় থেকে অনেকটা রক্ষা পাবে। তো চলুন শুরু করে দিই রান্নায় গ্যাসের সর্বোত্তম সন্তোষজনক ও ফলপ্রসূ ব্যবহার।