অন্ধ নিজে আলোর দেখা পায় না। তবে সে আলো ছড়াতে পারে। এ আলো জ্ঞানের আলো, যা মনের রাজ্যকে আলোকিত করে, সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে সামনে এগুনোর পথ দেখায়। অন্ধদের নিয়ে কয়েকটি শিক্ষামূলক গল্প নিয়েই আজকের আয়োজন।
অন্ধের হাতি দেখা:
ছয় অন্ধ একসাথে থাকে, একসাথেই চলাফেরা করে। চলতে চলতে একদিন এক মাহুতের সাথে দেখা। মাহুত বলে, আমি হাতিকে লালন-পালন করি, খাবার দিই, গোসল করাই। ছয় অন্ধ আগে কখনো হাতি দেখেনি। তারা মাহুতের কাছে হাতি দেখার বায়না ধরলো। মাহুত তাদেরকে হাতির কাছে নিয়ে গেলো।
অন্ধরাতো আর চোখে দেখতে পায় না। হাতে স্পর্শ করে, গন্ধ শুঁকে জিনিস চিনে নেয়। তারা তো আর হাতির বিশাল আকার সম্পর্কে জানে না। হাতরিয়ে হাতরিয়ে হাতির শরীরের যে অঙ্গ ধরতে পারলো, সেটাকেই হাতি মনে করতে লাগলো।
প্রথম অন্ধ, হাতির শুঁড় ধরল। দেখে সেটা কুণ্ডলী পাকায়, নড়ে-চড়ে, ফোঁস ফোঁস শব্দ করে। সে বলতে লাগলো, হাতি দেখতে অজগর সাপের মতো।
দ্বিতীয় অন্ধ ধরেছে হাতির বড় বড় দাঁতগুলো। সে প্রথম জনকে বলে, না ভাই। হাতি দেখতে অনেকটা গরুর লম্বা শিংয়ের মতো।
তৃতীয় অন্ধ, প্রথম জনের কাঁধে চড়ে বসেছে। সে হাতির কানগুলো পরখ করে বলতে লাগলো, হাতি হাতপাখার মতো। দুলে দুলে বাতাস দেয়।
চতুর্থ জন হাতির এক পা ধরেছে। সে বলে উঠলো, তোমাদের কারো কথাই ঠিক নয়। হাতি দেখতে গাছের মোটা গুঁড়ির মতো।
পঞ্চম জন বলে, না না! হাতি উঁচু ও প্রশস্ত দেয়ালের মতো। সে ধরেছিলো হাতির পেটের অংশবিশেষ।
শেষ অন্ধ হাতির লেজ ধরে চিৎকার করে বলে উঠলো, তোমরা সবাই মিথ্যা বলছো। হাতি অনেকটা কাছির মতো।
এসব নিয়ে অন্ধদের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেলো। সব দেখে হাতির মাহুত এগিয়ে গেলো। বলতে লাগলো, থামো থামো, তোমাদের সবার কথাই ঠিক। তবে তোমরা কেউই পুরো হাতি দেখোনি। হাতি একটা বিশাল জন্তু। একেক জন তার একটা করে অঙ্গ ধরেছ, আর ভেবেছ এটাই পুরো হাতি।
হারিকেন হাতে অন্ধ:
অমাবশ্যার রাত। মেঘের আড়ালে আকাশের তারাগুলো পর্যন্ত ঢাকা পড়েছে। চারিদিকে ঘুঁটঘুটে অন্ধকার। এমন অন্ধকার যে নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যায় না। একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। তাতে গ্রামের কাঁচা রাস্তা কাদা আর পানিতে মাখামাখি।
এমনি এক মুহুর্তে ডান হাতে লাঠি আর বাম হাতে জ্বলন্ত হারিকেন নিয়ে নিজ গন্তব্যে দিকে হেঁটে চলেছে এক অন্ধ। কোনো দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। পাশ দিয়ে যাতায়াত করছে যত চক্ষুষ্মানের দল।
অন্ধকে দেখে এক ছোকরার আর তর সইল না। সামনে পথ আগলে বলে বসল, আরে অন্ধ, তোর তো দেখার মুরোদ নেই। তা এই জ্বলন্ত হারিকেন নিয়ে পথ চলছিস কেনো।
ছোকরার কথা শুনে অন্ধ রাগ করলো না। বিনীত গলায় বলল, তোমার মতো চক্ষুবিশিষ্টরা যেনো অন্ধকারে আমার গায়ের উপর এসে না পড়ে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। ছোকরা অন্ধের জবাবের কোনো প্রতিউত্তর করতে না পেরে নিজের সম্ভ্রম নিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিলো।
অদেখা সৌন্দর্য:
বসরার এক অন্ধ ব্যক্তি বিয়ে করেছে। বাসর রাতে বধূটি বলল, তুমি যদি আমার রূপ-লাবণ্য ও উজ্জ্বল গোলাপি সৌন্দর্য দেখতে পেতে, তবে মুগ্ধতায় তোমার মাথা ঘুরে যেত।
অন্ধ লোকটি বলে উঠল, তুমি যেভাবে তোমার রূপের বর্ণনা দিচ্ছ, ব্যাপারটা আসলেই সে রকম হলে বসরাবাসী তোমাকে তো আমার জন্য এত সহজে ছেড়ে দেয়ার কথা না। তবে মন খারাপ করো না। তোমাকে নিয়ে আমি সন্তুষ্ট আছি।
উৎস: বুদ্ধির গল্প, পৃষ্ঠা-১৫১। গ্রন্থনা: মাওলানা শামীম আহমাদ। প্রকাশনায়: রাহনুমা প্রকাশনী।
নোট:
- কয়েকটা টাইটেল মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। “অন্ধ ছড়ায় আলো”, “অন্ধ বিলায় আলো”, “অন্ধ দেখায় আলো”, “অন্ধ দেখায় পথ” ইত্যাদি। শেষমেশ তৃতীয় টাইটেলটা সিলেক্ট করেছি।
- গল্পগুলো আমার নিজের নয়। বিভিন্ন সময়ে পড়েছিলাম। তবে নিজের মতো করে লিখেছি।
- গল্পগুলো কোথায় পড়েছিলাম তা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। আমার স্মৃতি যদি ঠিক থাকে তবে “অন্ধের হাতি দেখা” গল্পটি ইশপের। আর “হারিকেন হাতে অন্ধ” গল্পটি শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সম্পর্কে কোনো প্রবন্ধে পেয়েছিলাম।